প্রতারণার ফাঁদে রুকইয়া নামক সুন্নাতি চিকিৎসা

জ্বীন, যাদু, বদনজর, হিংসা বা হাসাদ এর জন্য কুরআন-সুন্নাহের আলোকে যে চিকিৎসা পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় তাকে “রুকইয়া শারিয়াহ” বলা হয়। ২০১৩-১৪ সালের পর হতে আমাদের দেশে রুকইয়া চিকিৎসা সোশ্যাল মিডিয়া সুবাদে এবং ইসলামিক স্কলারদের বক্তব্যের মাধ্যমে ব্যাপক প্রচার লাভ করে।

কিছু মানুষের মধ্যে তান্ত্রিক, যাদুকর, জৌতিষি, গণক, কবিরাজ, তাবজাতী, সাধক, মোল্লা-মুনশি, ওঝা হতে বের হয়ে কুরআন-সুন্নাহ সম্মত চিকিৎসা করার প্রেরণা সৃষ্টি হয়। এরা সহীহ সুন্নাহ সম্মত চিকিৎসার জন্য রাক্বী (যিনি রুকইয়া করেন তাকে রাকী বলা হয়) খুজতে থাকেন। এ সুযোগে স্বার্থানেষী মহল রুকইয়ার নামে তাদের সেই পুরাতন শয়তানী চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছে। বোতলের মাল একই শুধুমাত্র নাম পরিবর্তন হয়েছে।

এসব অসাধু ব্যবসায়ীরা জিনকে বন্দি করে, জবাই করে, জিনকে মেরে ফেলে, জ্বালিয়ে দেয়, জিনকে মুসলিম বানানো, তোলা রাশি ব্যবহার করে, ্ক্যাচার দিয়ে জিন ক্যাচ করে, ব্লাড ব্লক করে, ইত্যাদির মাধ্যমে জিনের সাহায্য নিয়ে চিকিৎসা করে, যা হারাম, শিরক, কুফর ও প্রতারণা।
وَأَنَّهُ كَانَ رِجَالٌ مِّنَ الْإِنسِ يَعُوذُونَ بِرِجَالٍ مِّنَ الْجِنِّ فَزَادُوهُمْ رَهَقًا
অনেক মানুষ অনেক জিনের আশ্রয় নিত, ফলে তারা জিনদের আত্নম্ভরিতা বাড়িয়ে দিত। [আল কুরআন, সূরা জিন, ৭২/৬]
এই আয়াতের আলোকে আলেমরা বলেন "জিনদের সাহায্য চাওয়া হারাম"।

জিনের সাহায্য নেয়ার পক্ষে দলিল হিসেবে সুলাইমান আলাইহিস সালাম এর ঘটনা উল্লেখ করতে দেখা যায় অনেককে। এটা সঠিক দলিল নয়।

সুলাইমান আলাইহিস সালাম এর এসব ঘটনা আমাদের জন্য দলিল না। এটা উনার জন্য ইউনিক (আলাদা)। আমাদের জন্য রাসূল সল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কিরামের আমল কি ছিল সেটা দেখা জরুরি। উনারা তদবিরের জন্য জিনের সাহায্য চাইতেন কি না?

আবূ হুরায়রা (রাদিআল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিতঃ রাসূলুল্লাহ‎ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, একটি অবাধ্য ইফরিত জ্বিন গত রাতে আমার সালাতে বাধা দিতে এসেছিল। আল্লাহ্‌ আমাকে তার উপর ক্ষমতা প্রদান করলেন। আমি তাকে ধরলাম এবং মসজিদের একটি খুঁটির সাথে বেঁধে রাখার ইচ্ছে করলাম, যাতে তোমরা সবাই স্বচক্ষে তাকে দেখতে পাও। তখনই আমার ভাই সুলাইমান (আলাইহিস সালাম)-এর এ দু’আটি আমার মনে পড়লো। “হে আমার রব! আমাকে ক্ষমা করুন এবং আমাকে এমন রাজ্য দান করুন, যা আমি ছাড়া আর কারও ভাগ্যে না জোটে” [আল কুরআন, সূরা সোয়াদ, ৩৮/৩৫]। অতঃপর আমি জ্বিনটিকে ব্যর্থ এবং লাঞ্ছিত করে ছেড়ে দিলাম। [সহীহুল বুখারী হা/৩৪২৩]

মূলতঃ সুলাইমান আলাইহিস সালামও জিনদের সাহায্য নেননি, বরং জিনরা উনার কাজ করতে বাধ্য ছিল। এজন্য সুলাইমান আলাইহিস সালামের ইন্তিকালের পরে তারা অন্য নবী কিংবা বাদশাহদের আনুগত্য করেনি।

কোরআনে আছে - পানির শয়তানরাও উনার অনুগত ছিল। এখন এতে পানিতে থাকা শয়তানদের কাছে সাহায্য চাওয়া বৈধ হয়ে যায় না।

আরেকটা বিষয় হলো, সুলাইমান আলাইহিস সালামের ওপর জাদুচর্চা-জিনসাধনার অপবাদ আজকে নতুন না। পূর্বের কিতাবি কাফেররাও এরকম অপবাদ দিত। এজন্য আল্লাহ কোরআনে আয়াত নাযিল করেছিলেন - "আর সুলাইমানের রাজত্বে শয়তানরা যা আবৃত্তি করত তারা তা অনুসরণ করেছে। আর সুলাইমান কুফরী করেননি, বরং শয়তানরাই কুফরী করেছিল। তারা মানুষকে শিক্ষা দিত জাদু এবং যা বাবিল শহরে হারূত-মারূত ফিরিশতাদ্বয়ের উপর নাযিল হয়েছিল......।" [আল কুরআন, সূরা বাকারা ২/১০২]

অনেকে নাকি জিনের সাহায্য নেয় না, ফেরেশতার সাহায্য নেয়! এটা মিথ্যা কথা। ফেরেশতারা নিজ ইচ্ছায় কিছু করে না। যতক্ষণ না আল্লাহর হুকুম হয়। কিয়ামতের দ্বীন আল্লাহ ফেরেশতাদের বলবেন “এরা কি তোমাদের উপাসনা করতো?” ফেরেশতারা বলবে “এরা জীনদের পূজা করতো, জিনদের কথাই বিশ্বাস করতো” [আল কুরআন, সূরা সাবা, ৩৪/৪১]

জিনের কাছ হতে সাহায্য গ্রহণকারী চিকিৎসকদের ব্যাপারে কোরআনে কি আছে -
যেদিন আল্লাহ সবাইকে একত্রিত করবেন, হে জিন সম্প্রদায়, তোমরা মানুষের মাঝে অনেককে তোমাদের অনুগামী করে নিয়েছ। মানুষদের মাঝে তাদের বন্ধুরা বলবেঃ হে আমাদের পালনকর্তা, "আমরা পরস্পরে পরস্পরের মাধ্যমে উপকার লাভ করেছি।" আর এখন আপনি আমাদের জন্যে যে সময় নির্ধারণ করেছিলেন, আমরা তাতে উপনীত হয়েছি।
তখন তাদের বলা হবে “আগুন হল তোমাদের বাসস্থান। সেখানে তোমরা চিরকাল অবস্থান করবে; আর আল্লাহ যেমন চাইবে..।” নিশ্চয় আপনার পালনকর্তা প্রজ্ঞাময়, মহাজ্ঞানী। [আল কুরআন, সুরা আন’আম, ৬/১২৮]

আমাদের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ পদ্ধতি হল, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, সাহাবায়ে কিরাম এবং পুর্বসুরি ইমামদের পদ্ধতি। তারা রুকইয়ার জন্য জ্বিনের সাহায্য চাইতেন নাকি আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইতেন?
তারা যে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইতেন, আমরাও তার কাছেই সাহায্য চাইবো।