মদিনা হিজরতের প্রস্তুতি

রাসূলুল্লাহ (সা.) এর সাহাবিদের অনেকেই এরই মধ্যে হিজরত করে মদিনায় চলে গেছেন। তখনও রাসূলুল্লাহ (সা.) মক্কায় অবস্থান করছেন। কখন মদিনায় হিজরতের হুকুম আসে সে অপেক্ষায় আছেন। আরও যারা তখনও মক্কায় অবস্থান করছিলেন তাদের মধ্যে ছিলেন আবু বকর সিদ্দিক (রা.), আলী ইবনে আবি তালিব (রা.), কাফেরদের হাতে বন্দি মুসলমানরা, দরিদ্র-অসহায় মুসলিম এবং ফেতনায় জড়িয়ে পড়া কিছু লোক।

আবু বকর (রা.) এর মেয়ে উম্মুল মোমেনিন আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) এর নিয়ম ছিল, খুব ভোরে বা সন্ধ্যায় সূর্যাস্তের সময় আবু বকরের ঘরে আসতেন। তবে যেদিন আল্লাহ তায়ালা নবীজিকে হিজরত ও মক্কা ত্যাগের অনুমতি দেন সেদিন ভর দুপুরে ঠিক মধ্যাহ্নের সময় আমাদের ঘরে আসেন, যখন ছিল প্রচন্ড গরম এবং সাধারণত ওই সময় তিনি আসেন না। আবু বকর রাসুলে করিম (সা.) কে দেখেই বললেন, আল্লাহর রাসুল এমন সময় এমনিতে আসেননি; নিশ্চয়ই কোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা আছে। নবীজি ঘরে প্রবেশ করলেন।
তখন আবু বকর বিছানার থেকে নেমে আসতে একটু বিলম্ব করলেন। এ অবসরে নবীজি ঘরের ভেতর বসলেন। তখন আমার (বাবা) আবু বকরের কাছে আমি ও আমার বোন আসমা ছাড়া আর কেউ ছিল না।

রাসুল (সা.) বললেন, তোমার কাছে যারা আছে তাদের বের করে দাও। তিনি বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! এরা আমার মেয়ে। আমার মা-বাবা আপনার জন্য কোরবান হোক, ব্যাপার কী? তিনি বললেন, আল্লাহ তায়ালা আমাকে মক্কা থেকে হিজরত করার অনুমতি দিয়েছেন। আবু বকর বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমিও কি সঙ্গে যাব? বললেন, হ্যাঁ, তুমিও আমার সঙ্গে যাবে। আয়েশা (রা.) বলেন, আল্লাহর কসম! এর আগে আমি কখনও দেখিনি যে, কেউ আনন্দের আতিশয্যে কাঁদে। সেদিন দেখলাম, আবু বকর কাঁদছিলেন। এরপর নবী করিম (সা.) এর উদ্দেশে বললেন, আমি এই দুইটি বাহনকে বহুদিন থেকে এ কাজের জন্য তৈরি রেখেছি। তিনি আবদুল্লাহ ইবনে আরকাত বা উরাইকাত লাইসিকে মদিনায় পথ দেখানোর গাইড হিসেবে ভাড়া করলেন, সে ছিল মোশরেক। বাহনগুলো তার কাছে দেয়া হলো, যাতে সে পশুগুলো চরানোর বাহানা করে নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছাতে পারে।

রাসূলুল্লাহর জীবনীকার মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক বলেন, নবী করিম (সা.) মক্কা ছেড়ে মদিনায় হিজরত করার সময় আবু বকর ও তার পরিবার এবং আলী ইবনে আবি তালেব ছাড়া অর কেউ এ সম্পর্ক কিছু জানত না। রাসুল (সা.) মক্কা ত্যাগের পরিকল্পনার কথা আলী ইবনে আবি তালেব (রা.) কে অবহিত করেন এবং তাকে নির্দেশ দান করেন যে, নবীজি চলে যাওয়ার পর তিনি মক্কায় অবস্থান করবেন এবং নবীজির কাছে লোকজনের গচ্ছিত আমানত তাদের কাছে হস্তান্তর করবেন। এ ছাড়া রাসূলুল্লাহর যেসব জিনিস মানুষের হাতে আছে তাও গ্রহণ করবেন।

মক্কাবাসী রাসূলুল্লাহকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করার কারণে তিনি মাতৃভূমি ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। অথচ এ পরিস্থিতিতেও তিনি তাদের গচ্ছিত আমানত তাদের কাছে পৌঁছে দেয়ার বিরাট ঝুঁকির মধ্যে আপন চাচাতো ভাই আলী ইবনে আবি তালেবকে রেখে যাচ্ছেন। টাকা-পয়সা বা অস্থাবর সম্পদ গচ্ছিত রাখার মতো ব্যাংক বা বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠান তখনকার দিনে দুর্লভ ছিল। প্রমাণ হচ্ছে, মক্কাবাসী যাকে শত্রুজ্ঞানে হত্যার পরিকল্পনা করেছে সেই আল-আমিনই তাদের সম্পদের বিশ্বস্ত আমানতদার। সত্যিই মহানবী (সা.) এর ব্যক্তিত্ব কত মহান ছিল।

রাসূলুল্লাহর মদিনায় হিজরত ও মক্কা ত্যাগের দিনক্ষণ নির্ধারিত হয়েছে আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ অনুযায়ী। কিন্তু তিনি সফরের যাবতীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করেছেন। সব কিছু আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিয়ে বসে থাকেননি। এখানেই আজকের মুসলমানদের জন্য বিরাট শিক্ষা রয়েছে, যারা ধর্মীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আসলে বলে যে, আল্লাহর দ্বীনের বিষয় আল্লাহ দেখবেন।

লক্ষণীয় হচ্ছে, অত্যন্ত সূক্ষ্ম পরিকল্পনার আওতায় তিনি সবকিছু অত্যন্ত গোপনে সম্পন্ন করেছেন। কাউকে জানতে দিচ্ছেন না এবং আগাগোড়াই গোপনীয়তা রক্ষা করেছেন। সফরে মদিনার পথ দেখানোর জন্য একজন গাইড ঠিক করেছেন, আর সে একজন মোশরেক।
এসব কিছুই আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুলের আওতায় তিনি করেছেন। অর্থাৎ নিজের বুদ্ধি বিবেচনা ও জাগতিক যাবতীয় পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করার পর পরিণতির জন্য আল্লাহর ওপর ভরসা করার নামই তাওয়াক্কুল বা আল্লাহ ভরসা।